তোমরা সপ্তম শ্রেণিতে বিভিন্ন পেশি সম্পর্কে জেনেছ। অভ্যন্তরীণ অঙ্কা এবং রক্তনালির গায়ের অনৈচ্ছিক পেশি, হৃৎপিন্ডের হৃৎপেশি এবং অস্থিগাত্রের সাথে লাগানো ঐচ্ছিক কঙ্কাল পেশি নিয়ে পেশিতন্ত্র পঠিত। পেশিতন্ত্র বিভিন্ন ধরনের গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে থাকে। যেমন:
• অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সঞ্চালন, চলাফেরায় সহায়তা, অঙ্গবিন্যাস এবং ভারসাম্য রক্ষা করা।
• কঙ্কালতন্ত্রের সাথে যৌথভাবে দেহের নির্দিষ্ট আকার গঠন করা।
পেশিতে গ্লাইকোজেন সঞ্চয় করে ভবিষ্যৎ জরুরি প্রয়োজনে শন্তির উৎস হিসেবে ব্যবহার করা।
• বিশেষ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হওয়ায় হৃৎপেশির হৃৎপিন্ডের স্পন্দন এবং রক্ত সঞ্চালনের দায়িত্ব পালন করা।
• মলমূত্র ত্যাগ, পরিপাকনালির মধ্য দিয়ে খাদ্যবস্তুর চলন প্রভৃতি স্বয়ংক্রিয় কাজে ভূমিকা পালন।
মানুষের চলনে অস্থি ও পেশির ভূমিকা
মানুষের চলনে অস্থি ও পেশির ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। অস্থি দেহের কাঠামো কঙ্কাল গঠন করে, আর পেশিতন্ত্র এই কাঠামোর উপর আচ্ছাদন তৈরি করে। ঐচ্ছিক পেশি টেন্ডন নামক দৃঢ় এবং স্থিতিস্থাপক এক ধরনের পেশি দিয়ে অস্থিকে আটকে রাখে। স্নায়বিক উত্তেজনা পেশির মধ্যে উদ্দীপনা জাগানোর ফলে পেশি সংকুচিত হয় আবার উদ্দীপনা সরিয়ে দিলে পেশি পুনরায় শিথিল বা প্রসারিত হয়। এই সংকোচন এবং প্রসারণের সাহায্যে সংলগ্ন অস্থির নড়াচড়া সম্ভব হয়। এভাবে পেশি কোনো অঙ্গকে প্রসারিত করে, কোনো অঙ্গকে ভাঁজ করে, কোনো অঙ্গকে উপরের দিকে উঠায়, কোনো অঙ্গকে নিচে নামায় বা কোনো অঙ্গকে প্রধান অক্ষের চারপাশে, ডানে-বাঁয়ে ঘোরায়।
একটি উদাহরণ দিয়ে পেশির কার্যক্রম ব্যাখ্যা করা যায়। কনুই বাঁকা বা সোজা করতে হলে ঐচ্ছিক পেশি কীভাবে কাজ করে সেটি লক্ষ কর। কনুই বাঁকা করতে হলে ইচ্ছাধীন স্নায়ুর তাড়নায় বাইসেপস পেশি সংকুচিত হয় এবং ট্রাইসেপস পেশি শিথিল হয়ে প্রসারিত হয়। ফলে রেডিয়াস ও আলনাকে হিউমেরাসের কাছে নিয়ে আসে। কনুই সোজা করতে হলে ঠিক তার বিপরীত কার্যক্রমটি ঘটে, অর্থাৎ ইচ্ছাধীন স্নায়ুর তাড়নায় ট্রাইসেপস পেশি সংকুচিত হয় এবং রেডিয়াস ও আলনাকে টেনে সোজা করে হিউমেরাসের সাথে প্রায় এক সরলরেখায় নিয়ে আসে। এ সময় বাইসেপস পেশি শিথিল হয়ে প্রসারিত হয়। এভাবে বাইসেপস এবং ট্রাইসেপস পেশির সংকোচন এবং শ্লথ হওয়ার মাধ্যমে আমরা কনুই ভাঁজ করতে আর খুলতে পারি। এভাবে দেহের বিভিন্ন পেশি কার্যক্রমের মাধ্যমে বিভিন্ন অঙ্গের সঞ্চালন ঘটে।
টেনডন (Tendon) ও লিগামেন্ট বা অস্থিবন্ধনী (Ligament)
আমরা তোমাদের যখন বলি পেশি হাড়ের সাথে আটকে থাকে অথবা একটি হাড়ের সাথে অন্য হাড় বন্ধনীর সাহায্যে আটকে থাকে, তখন সেটি কীভাবে ঘটে তা নিয়ে তোমাদের নিশ্চয় কৌতূহল হয়। মাংসপেশির প্রান্তভাগ দড়ি বা রজ্জুর মতো শক্ত হয়ে অস্থির পায়ের সাথে সংযুক্ত হয়। এই শন্ত প্রান্তকে টেনডন বলে। টেনডন ঘন, শ্বেত তন্দুময় যোজক টিস্যু দিয়ে গঠিত। এ ধরনের টিস্যুর অন্তঃকোষীয় পদার্থ বা ম্যাট্রিক্সে শাখা-প্রশাখাবিহীন শ্বেততন্ধু ছড়ানো থাকে। এরা গুচ্ছাকারে এবং পরস্পর সমান্তরালভাবে বিন্যস্ত থাকে। অনেকগুলো তন্তু একত্রে আঁটি বা বান্ডিল তৈরি করে। আঁটিগুলো একত্রে দলবদ্ধ হয়ে আঁটিগুচ্ছ তৈরি করে। আঁটিগুচ্ছগুলো আবার তকুময় টিস্যুগুচ্ছ বা অ্যারিওলার টিস্যু দিয়ে বেষ্টিত হয়ে আরো বড় আঁটিতে শ্রেণিবঙ্গ হয়। অ্যারিওলার টিস্যুর দৈর্ঘ্য বরাবর টেনডনের মধ্যে রন্তনালি, লসিকানালি এবং স্নায়ু প্রবেশ করে। টেনডনের স্থিতিস্থাপকতা তুলনামূলকভাবে বেশ কম।
পেশি এবং টেনডনের সংযোগস্থলে টেনডন তন্তুগুলো পেশিতন্ধুর সারকোলেমায় সংযোজিত হয়। পেশি এবং টেনডনের সংযোগকে আরও শক্তিশালী করার জন্য টেনডনের আঁটিগুচ্ছ বেষ্টনকারী অ্যারিওলার টিস্যু, পেশি বান্ডিল বা আঁটির আবরক টিস্যুর সাথে অবিচ্ছিন্ন যোগাযোগ তৈরি করে। টেনডন বেশ শক্ত। অস্থি বা পেশির তুলনায় টেনডনের ভেঙে বা ছিঁড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক কম, তবে কোনোভাবে যদি তা ছিঁড়ে যায়, তাহলে সহজে জোড়া লাগে না। পেশিবন্ধনী পেশিপ্রান্তে রজ্জুর মতো শন্ত হয়ে অস্থির সাথে সংযুক্ত থাকে। পেশি অস্থির সাথে আবদ্ধ হয়ে দেহকাঠামো গঠনে, দৃঢ়তা দানে, অস্থিবন্ধনী গঠনে সাহায্য করে এবং চাপটানের (tensile strength) বিরুদ্ধে যাত্থিক প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
পাতলা কাপড়ের মতো কোমল অথচ দৃঢ়, স্থিতিস্থাপক যে বন্ধনী দিয়ে অস্থিগুলো পরস্পরের সাথে সংযুক্ত থাকে তাকে অস্থিবন্ধনী বা লিগামেন্ট বলে। লিগামেন্ট শ্বেততন্ধু এবং পীততচ্ছু এই দুই ধরনের ইলাস্টিক তম্মু দিয়ে পঠিত।
এতে পীতবর্ণের স্থিতিস্থাপক তকুর সংখ্যা বেশি থাকে। এর মধ্যে সরু, শাখা-প্রশাখা বিশিষ্ট জালাকারে বিন্যস্ত কতগুলো তন্ধুও ছড়ানো থাকে। এ তন্তুগুলো গুচ্ছাকারে না থেকে আলাদাভাবে অবস্থান করে। এদের স্থিতিস্থাপকতা তুলনামূলকভাবে বেশি। ইলাস্টিক তক্ষুগুলো ইলাস্টিন নামক প্রোটিন দিয়ে তৈরি। কব্জা যেমন পাল্লাকে দরজার কাঠামোর সাথে আটকে রাখে। একইভাবে অস্থিবন্ধনী বা লিগামেন্ট হাড়কে আটকে রাখে। এতে অজ্ঞাটি সবদিকে সোজা বা বাঁকা হয়ে নড়াচড়া করতে পারে এবং হাড়গুলি স্থানচ্যুত ও বিচ্যুত হয় না।